সানগ্লাস পর্ব-২ নিতু
_সুমাইয়া আমান নিতু
কলপসিবল গেট পার হয়ে ভেতরে ঢুকল নাদিম। বাড়িতে বিয়ে বিয়ে গন্ধ। অনেকদিন এই গন্ধ পাওয়া হয় না। তার মনের ভেতরেও খুশির ছোঁয়া লেগে গেল। ভেতরে প্রচুর কোলাহল। এদিকটাতে মানুষজন দেখা গেল না তেমন। প্রথমে ঢুকে ছোট একটা ঘর, সেখানে বসে দুই বৃদ্ধা গল্প করছে। সে ঢুকতেই এক মোটাসোটা লোকের দেখা পেল। ফর্সা গোলগাল লোকটা পরে আছে মেরুন সুতোর কাজ করা ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। দাড়িগোঁফ কামানো, চুল ছোট করে কাটা। চেহারায় সুখী মানুষের ছাপ আছে। নাদিমকে দেখেই হো হো করে এগিয়ে এল।
"আরে তামিম যে..কখন এলে? তোমার না আরও পরে আসার কথা। আছো কেমন? আরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসো, ভেতরে আসো..."
নাদিম বলতে চাইল সে তামিম না, কিন্তু বলার সুযোগ পেল না। লোকটা অনর্গল কথা চালিয়ে যাচ্ছে। "কখন ল্যান্ড করলে? ফ্লাইট তাড়াতাড়ি চলে এলো? তোমার আরও দু'ঘন্টা লেটে আসার কথা! ও মাই গাড! সবাই যা চমকে যাবে না! তুমি ভোঁতা মুখ করে আছ কেন? হাসো!"
তামিম হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসিটা যুতসই হলো না। সে কিছু বলতে চেষ্টা করল আবার৷ কিন্তু ততক্ষণে এক মহিলা এসে হাজির। লোকটা চেঁচিয়ে বলল, "ওগো এইযে দেখো তামিম চলে এসেছে! আগে এসে আমাদের কেমন সারপ্রাইজ দিল বলো তো!"
মনে হলো লোকটা মহিলার স্বামী। মহিলাটিও স্বামীর মতো মোটাসোটা, ফর্সা, আর সুন্দরী। সে দুই গালে হাত দিয়ে বলল, "ওমা! কী সুন্দর হয়েছ গো! কিন্তু বড্ড শুকিয়ে গেছ তুমি! প্লেনে এতদূর এলে যা হয়! সেদিনও ভিডিও কলে কথা হলো, তখন তো স্বাস্থ্য ভালো ছিল!"
তামিম মনে মনে বলল, "স্বাস্থ্যর কথা মনে আছে, চেহারা মনে নেই? মাথা খারাপ নাকি এদের?"
নাদিমের কোনো কথা সেও শুনতে আগ্রহ বোধ করল না। স্বামীর ওপর চোটপাট দেখাতে শুরু করল, "ওকে এখানে রেখেছ কেন? ঠান্ডার দেশ থেকে এসে দেখ ছেলেটা কত ঘামছে! ওর জন্য এসি রুম ঠিক করা হয়েছে দোতলায় জানো না! খালামণি বলেছে এলেই ওকে ওই রুমে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। ওদের দেশে কি এখানকার মতো মড়ার গরম পড়ে?"
নাদিম পুনরায় কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। একটা বাচ্চা এসে মহিলাটার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে, "আম্মু আমাকে ছোত আন্তি দই দেয় না..."
মহিলা বাচ্চার গাল টিপে দিয়ে বলল, "চলো আমি দেই।" এরপর স্বামীর দিকে চেয়ে বলল, "ওকে সবাই এখুনি দেখলে ছাড়বে না। একেবারে জ্বালিয়ে মারবে। ওকে একটু রেস্ট নিতে দাও। চুপিচুপি নিয়ে যাও তো দোতলায়।"
বলেই ছেলের হাত ধরে ভেতরের দিকে গেল। ছেলেটাও বাবা মায়ের মতো গোলগাল। বাবার মতো মেরুন কাজ করা ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরেছে। একটু তোতলা। তাও থেমে থেমে কথা বলে চলেছে।
লোকটা বলল, "আমাকে চিনেছ তো তামিম? আমি জিবরান। তোমার এই কলি আপার হাজবেন্ড। তোমাকে ছবিতে দেখেছি, কিন্তু আমাকে তুমি দেখোনি।"
"ওহ।"
"এই তামিম তোমার লাগেজ কোথায়?"
নাদিম বলতে নিল, "আমি তামিম না.."
কিন্তু কে শোনে কার কথা! যে দুটো বুড়ি সেখানে বসে গুটুর গুটুর গল্প করছিল তাদের একজন আবার পানের বাটা নিয়ে পান সাজাচ্ছিল কথার ফাঁকে। সুন্দর করে পানের চারপাশে চুন, সুপারি, জর্দা, খয়ের, মৌরি দিয়ে সাজিয়ে কায়দা করে ভাজ করে সেগুলো একটা গোল পিতলের থালায় রাখছিল। একটা পান নিয়ে সে নাদিমের কথার মধ্যে জিবরান সাহেবকে ডেকে বলল, "ও জামাই, এই লও তোমার স্পিশাল পান। বেশি জর্দা দিছি।"
"নানী গো নানী, কত ভালো আপনি!" বলে একগাল হেসে পুরো পান মুখে পুরে দিল জিবরান সাহেব। একটু পরেই নানীর সাথে কথা বলতে গিয়ে পানের রস গড়িয়ে তার থুতনি বেয়ে নেমে এলো নিচে। পাঞ্জাবিতে লাল টকটকে রক্তের মতো রঙ মাখিয়ে দিল সেটা। জিবরান সাহেব হায় হায় করে উঠল।
টিস্যু দিয়ে পিক মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে নাদিমের দিকে ফিরে বলল, "তামিম প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। তুমি এই দরজা দিয়ে চলে যাও, সবাইকে পেয়ে যাবে।"
জিবরান সাহেব চলে গেলেন বুকের পানের পিক মুছতে মুছতে। যেতে যেতে বিড়বিড় করতে শোনা গেল, "কলি আমি সরি। ইচ্ছে করে করিনি..."
নাদিম এবার তাকাল বুড়ি দুটোর দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো সে বিদেশ থেকে আগত কোনো বিশেষ অতিথির তকমা পাওয়া সত্ত্বেও মহিলা দুটি তার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। নিজেদের মতো গল্প বলছে। নাদিম একটু খেয়াল করে শুনে দেখল তারা ভূতের গল্প বলছে। পান সাজানো নানী বলছে, "আমাগো বাড়িত যে বড় কাডল গাছটা আছে ওইডার তিন নম্বর ডালে থাহে শাকচুন্নি। অমাবস্যার দিন গান গায়। হের গান শুইনা দুই বার হাতে তালি না দিলে সারা রাইত চিক্কুর পারে..."
নাদিম একবার ভাবল বেরিয়ে যায়। কিন্তু যে কাজে এসেছে সেটা না করে কেমন করে যাবে? সিদ্ধান্ত নিল ভেতরেই যাবে। যদিও তাকে যেতে হলো না। এক অষ্টাদশী তরুনী ছুটে এসে জাপটে ধরল তাকে। নাদিমের ভীষণ লজ্জা হতে লাগল। সে সরিয়ে দেবার আগেই অবশ্য মেয়েটা তাকে ছেড়ে দিল। বলল, "একি তামিম ভাই বিদেশ থেকে এভাবে এসেছেন?"
নাদিম খেয়াল করল তার পরনে একটা হালকা আকাশী রঙের শার্ট, যেটার কয়েক দফা ঘামে ভিজে ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে একটা মোটামুটি পুরানো ঘড়ি, বেশ কয়েকদিন চুল কাটা হয় না, আজকে শেভও করা হয়নি, চেহারাটা নিশ্চিয়ই বাদরের মতো লাগছে! লোকগুলারও কী সেন্স! তাকে বিদেশ ফেরত তামিম বানিয়ে দিচ্ছে! আচ্ছা তার চেহারা কি এদের তামিমের মতো? সে শুনেছে পৃথিবীতে ছয়টা মানুষের নাকি একরম চেহারা হয়!
সে শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে বলল, "আমার কথা শুনুন প্লিজ, আমি তামিম না।"
"তো কে? ভূত? তাই তো হয়ে এসেছেন! দেখেন তামিম ভাই! আমি এখন এডাল্ট! আমার সাথে বাচ্চাদের মতো জোক করবেন না ওকে?"
টেনে টেনে কথাগুলো বলতে বলতে তিনবার কপালের চুল সরালো মেয়েটা। তারপর ওর হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। সে ঢুকতেই চারটা বক্সে একত্রে গান বাজতে শুরু করল, "তোকে দেখে গাইছে এমন রিমিক্স কাওয়ালি...."
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
0 মন্তব্যসমূহ