সানগ্লাস পর্ব-১ নিতু

সানগ্লাস পর্ব-১ নিতু

_সুমাইয়া আমান নিতু

সানগ্লাস পর্ব-১ নিতু
সানগ্লাস পর্ব-১ নিতু Source_google


 গেট দিয়ে ঢুকতেই বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিল। মনে পড়ে গেল সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। বাড়িটা দোতলা। সামনে খানিক ফাঁকা জায়গা। তারই একধারে দুটো বাবুর্চি বড় বড় ডেগচিতে রান্না বসিয়েছে। ইট দিয়ে বানানো চুলায় গনগনে আগুনে ভাজা হচ্ছে মসলা। নাদিমের পেটের ভেতরটা পাক খেয়ে উঠল। মনে হচ্ছে একটা রাক্ষস পেটে ঢুকে দুমদাম কিল মারছে। সে অনেক কষ্টে চোখ সেদিক থেকে সরিয়ে বাড়ির দিকে চাইল।

দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ি। পুরো বাড়ি মরিচবাতি দিয়ে সাজানো। দিন বলে সেগুলো জ্বলছে না। গেটের কাছটা রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো। কিন্তু বিয়ে বাড়ি কেমন করে হয়? সে তো এসেছে শেষকৃত্যে! হায় হায় ভুল করে অন্য বাড়িতে ঢুকল না তো?
নাদিম বাইরে চলে গেল। মোবাইল বের করে ঠিকানাটা আবার মিলিয়ে নিল। বাড়ির নাম এটাই, 'আলতা ভিলা'৷ ঠিকানাও মিলল। মালিকের নামটাও মিলে গেছে- আতাউর রহমান। তাহলে এই বাড়িতে বিয়ে হবে কেন! মাত্র চারদিন আগে না আতাউর রহমান মারা গেছেন? অবশ্য এখনকার লোকজন যা তা হয়ে গেছে! শেষকৃত্যে অনুষ্ঠান করে ধুমধাম করে। দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করে খাওয়ায়। গিফটও হয়তো দেয়া-নেয়া হয়। ভয়াবহ ব্যাপার।
সে আরেকবার ভেতরে ঢুকল। তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে কয়েকটা ছোট ছোট মেয়ে বেরিয়ে গেল। বয়স আট-দশ হবে। সেজেগুজে ঘুরছে। সবার হাতে বাসি গাদা ফুলের মালা। নাদিম বুঝে ফেলল এটা আসলেই বিয়ে বাড়ি। ফুলগুলো গতকাল গায়ে হলুদের স্টেজে সাজানো হয়েছিল।
সে আবার বেরিয়ে পড়ল। অদ্ভূত লাগছে। কী ভেবে এসেছিল, কী হচ্ছে! ভেতরে গিয়ে কী বলবে তাও বুঝতে পারছে না। এতদূর এসেছে, এমনি এমনি তো আর ফেরত যেতে পারে না। অস্বস্তি তো হচ্ছেই, সাথে পেটে গুড়গুড় করছে ক্ষিধে। এই ভরদুপুরে দোকানপাটও তেমন খোলা নেই। একটা চায়ের দোকানের ঝাপ অর্ধেক খোলা। সে এগিয়ে গেল সেদিকে। দোকানের বেঞ্চিতে বসে আর চা খেতে ইচ্ছে হলো না। এক প্যাকেট সিগারেট কিনে উঠে পড়ল। অস্থির লাগছে।
সচরাচর সিগারেট খায় না নাদিম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে এক আধ টান- এই আর কি। এখন কী মনে করে কিনেছে নিজেও বুঝতে পারছে না৷ সিগারেটটা ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিল। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে আলতা ভিলার সোজাসুজি রাস্তার অপর পাশে। বাড়িটা ঘিরে আছে অনেকগুলো লম্বা লম্বা সুপারি গাছ। এদিকটাতে দোতলার দুটো বারান্দা আছে। তাতে মাঝে মধ্যে দু-একটা মেয়ে দেখা যাচ্ছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে যাওয়া আসা করতে। ছাদে প্যান্ডেল। বাড়ির পাঁচিল বেশ উঁচু। তার ওপর কাচের টুকরো গাঁথা। চোর ঢুকতে পারবে না।
আতাউর রহমান নাদিমের বাবার বন্ধু ছিলেন৷ একসঙ্গে তারা দীর্ঘদিন ইতালিতে ছিলেন। দুজনেই দেশে ফিরেছেন অনেক বছর আগে। তারপরেও যোগাযোগ ছিল। কিন্তু আলাদা শহরে বাস করায় দেখা সাক্ষাৎ কমই হতো। হঠাৎ গতকাল বাবা খবর পেয়েছেন আতাউর রহমান নাকি তিন দিন আগে মারা গেছেন। বাবা ভীষণ কষ্ট পেলেন। শেষ দেখাটা বন্ধুকে দেখতে পারলেন না। আজ শেষকৃত্যে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একটা খুবই জরুরি কাজে আটকে পড়লেন। নাদিমকে পাঠিয়ে দিলেন ঠিকানা দিয়ে। শুধু যে শেষকৃত্যে থাকতে তা নয়, আরেকটা ব্যাপার আছে। সেটার জন্যই এত অস্বস্তি।
আচ্ছা আজ বিয়েটা কার? আতাউর রহমানের ছেলে বা মেয়ের? লোকটার কথা অনেক শুনলেও তার ছেলেমেয়ের কথা কখনো বাবার মুখে শোনেনি নাদিম। হতে পারে মারা যাবার আগে বলে গেছেন তার শেষ ইচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব অমুকের সাথে ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিতে। কিন্তু তাই বলে মরার চতুর্থ দিনে? ধ্যাৎ!
বাবাকে কেউ মিথ্যে বলেনি তো? কিন্তু মৃত্যু নিয়ে কে ঠাট্টা করবে? আবার এটাও হতে পারে, বাবা ভুল শুনেছে। নাদিম বাবাকে ফোন করল। উনি ধরলেন না। বার কয়েক চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া গেল না।
নাদিম হঠাৎ খেয়াল তার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আরও এক মূর্তি সিগারেট টানছে। ঠোঁটদুটো নিকোটিনের ভালোবাসায় পুড়ে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। গায়ের রঙও কালোমতো। গায়ে ময়লা শার্ট প্যান্ট৷ শার্টের ওপরের বোতাম খোলা। গলায় রূপালী রঙের চেইন ঝুলছে। লম্বা উষ্কখুষ্ক চুল জট পাকিয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে কয়েকদিন ঘুমায় না।
ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা এগিয়ে এসে বলল, "কী ভাই! আপনেও আমার দলের মানুষ নাকি?"
"কিসের দল?" ভুরু কুঁচকালো নাদিম।
"আরে আমিও ছ্যাকা খাইয়া ব্যাকা হইছি। তাও শেষবারের মতো ওরে দেখতে আইছি। জানি না ভিতরে যাইতে পারুম নাকি।"
"কে ছ্যাকা দিয়েছে?"
"কেডা আবার! আয়না। সে তো মেমসাহেব। তাই গরীবের ভালোবাসা বুঝল না।"
নাদিম এতক্ষণে বুঝল বিয়েটা আয়না নামের কোনো মেয়ের। সে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, "আয়না কি আতাউর রহমানের মেয়ে?"
"জি। ওই বুইড়া-" বলতে বলতে কী মনে করে থেমে গেল ছেলেটা।
নাদিমের খুব জিজ্ঞেস করতে মন চাইল, আতাউর রহমান কি বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন? কিন্তু প্রশ্নটা খুবই বিদঘুটে শোনায় বলে করতে পারল না।
ছেলেটা ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, "আয়নার জন্য আসেন নাই তো এই বাড়ির দিকে চাইয়া আছেন ক্যান?"
নাদিম কিছু না বলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। ছেলেটা বোধহয় সত্যি মারাত্মক কষ্টে আছে। তাই আর প্রশ্ন করল না। সিগারেট শেষ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গান ধরল- " লাল শাড়ি পরিয়া কন্যা রক্ত আলতা পায়..আমার চোখের জল মিশাইলা, নিলা না বিদায়..."
নাদিম পায়ে পায়ে সরে গেল। আবারও ভাবল ভেতরে যাবে নাকি যাবে না। অগত্যা ঢুকেই পড়ল। যা হয় হবে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ